
হস্তজাত পণ্য তৈরি করে অনেক নারী জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। একই সঙ্গে শত শত নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
নওরিন আক্তারের বাড়ি জামালপুর শহরের মিয়াপাড়া এলাকায়। তিনি আনন্দ মোহন কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি হস্তশিল্পের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘এই শহরে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে হস্তশিল্প—সৃষ্টি হয়েছে অনেক নারীর কর্মসংস্থান।’ এই কাজ করে মাসে যা আয় হয়, তা দিয়ে তিনি লেখাপড়া ও ব্যক্তিগত খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন। এখন তিনি নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিষয়টি হলো, নদীভাঙন ও দারিদ্র্যপীড়িত জামালপুর জেলায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। কাপড়ে সুচ ফুটিয়ে নিপুণ হাতে কারুকাজখচিত বাহারি পণ্য তৈরি করছেন এই জনপদের নারীরা। তাঁদের হাত ধরে জামালপুর এখন হস্তশিল্পের শহর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই শিল্পের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে সরকার ইতিমধ্যে জামালপুর শহরের কম্পপুর এলাকায় বিশাল এক নকশিপল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। জেলার হস্তশিল্প উদ্যোক্তারা এখন এই পল্লির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
জামালপুর শহরের অলিগলিতে অনেক ঘরেই হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কাজ করে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। যেসব পণ্য তাঁরা তৈরি করছেন, সেগুলো হলো, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, বিছানার চাদর, কুশন কভার, শাড়ি, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, হাতপাখাসহ নানা পণ্য। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও যাচ্ছে এসব পণ্য। হস্তজাত পণ্য তৈরি করে অনেক নারী জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। একই সঙ্গে শত শত নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আর তাতে বছরে শতাধিক কোটি টাকার হস্তশিল্প বিক্রি হচ্ছে এই জেলা থেকে।
তবে করোনার থাবায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। অনেক উদ্যোক্তা ঝরে পড়েছেন। অনেকেই বহু কষ্টে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
এই শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। একসময় সম্ভাবনাময় এই শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। গ্রামাঞ্চলের নারীদের নিপুণ হাতের জাদুতে আবারও এই শিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে এই শিল্প দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়াচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী-পুরুষ এখন এই পেশায় জড়িত। তার ৮০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের নারী। সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তাঁরা ঘরে বসেই হস্তশিল্প ও নকশিকাঁথার বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। বাড়তি আয়ের জন্য অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীরাও এই পেশায় আসছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের ঢাকাইপট্টি থেকে দেওয়ানপাড়া পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশে নারীদের পরিচালিত হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির কারখানা ও দোকান গড়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় চোখে পড়ে সারি সারি হস্তশিল্পের দোকান। অনেক আবাসিক ভবনেও বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আমলাপাড়া, বসাকপাড়া, কলেজ রোড, বকুলতলা, জিগাতলা, মুন্সিপাড়া, মিয়াপাড়া, বেলটিয়া, পাথালিয়া, পাঁচ রাস্তা মোড়, কাছারিপাড়াসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় হস্তশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র
এর সঙ্গে নকশিপল্লি চালু হলে ব্যবসায় আরও গতি আসবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। এতে পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যা অনেকটাই মিটবে। তখন দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা নকশিপল্লিতে এসে সহজেই পছন্দের পণ্য কিনতে পারবেন।
এ ছাড়া দেশের বাইরেও এসব হস্তশিল্পের ব্যাপক চাহিদা আছে। ইতিমধ্যে সরকার হস্তশিল্পকে জামালপুরের ব্র্যান্ড পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই বাস্তবতায় নকশিপল্লির নির্মাণকাজ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
জামালপুরের হস্তশিল্প ব্যবসায়ীরা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। তাঁদের মতো দেশের অন্যান্য এসএমই উদ্যোক্তারাও এখন স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্রের দাবি করছেন। বিষয়টি হলো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হয় না। সে জন্য সরকার তাঁদের জন্য স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র নির্মাণ
করে দিলে ব্যবসার অনেক প্রসার ঘটবে বলেই তাঁরা মনে করেন।
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি (নাসিব) জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি মো. শাহিনুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় বড় উদ্যোক্তা আছেন প্রায় আড়াই হাজার। সব মিলিয়ে এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী-পুরুষ যুক্ত। হস্তশিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হতদরিদ্র নারী শ্রমিকেরা যেমন সঠিক মূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এই জেলায় গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পুরো বদলে যাবে।
কোভিডের প্রভাব
তবে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এই শিল্পের কাঁচামালের দাম অনেকটাই বেড়েছে। একদিকে কারোনার প্রভাব, অন্যদিকে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি—এই দুই কারণে অনেক ছোট উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে ঝরে পড়েছেন। কোভিড মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণ বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই পাননি। তবে উদ্যোক্তারা সাধারণত এসএমই ঋণ নিয়ে থাকেন। এই শিল্প আরও এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করেন।